ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে হরিণের মায়ায় মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-01-2023    169
ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে হরিণের মায়ায় মুগ্ধ দর্শনার্থীরা

বনজঙ্গলের হরিণ মানুষ দেখলেই দৌড়ে পালায়। বাঘ-সিংহের খাদ্য হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকে সব সময়। কিন্তু এই হরিণের চরিত্র ভিন্ন রকম, জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে নেই কোনো শঙ্কা। মানুষ দেখলেই ছুটে আসে, চারপাশে ঘুরঘুর করে। আদর করে কলা কিংবা গাজর খেতে দিলে খুশি প্রাণীটি।

হরিণের এমন মায়ায় মুগ্ধ হচ্ছেন কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে আসা দর্শনার্থীরা। প্রতিদিন ১ হাজারের বেশি দর্শনার্থী কক্সবাজার শহর থেকে ৭৫ কিলোমিটার দূরে সাফারি পার্কে হরিণের এমন দৃশ্য উপভোগ করছেন।

২০০১ সালের ১৯ জানুয়ারি ২ হাজার ২৫০ একর বনাঞ্চলে গড়ে তোলা হয় দেশের প্রথম এই সাফারি পার্ক। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। বর্তমানে পার্কের ১৯টি বেষ্টনীতে আছে সিংহ, বাঘ, জেব্রা, ওয়াইল্ড বিস্ট, জলহস্তী, ময়ূর, অজগর, কুমির, হাতি, ভালুক, হরিণ, লামচিতা, শকুন, কচ্ছপ, রাজধনেশ, কাকধনেশ, ইগল, সাদা বক, রঙিলা বক, সারস, কাস্তেচরা, মথুরা, নিশিবক, কানিবক, বনগরুসহ ৫২ প্রজাতির ৩৪১টি প্রাণী। আর বনাঞ্চলে উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির ১ হাজার ৬৫টি প্রাণী।

সম্প্রতি পার্ক ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ দর্শনার্থীর নজর হরিণের দিকে। বাঘ ও সিংহের হুংকার শুনতে শুনতে হরিণের মায়াজালে আবদ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। সাফারি পার্কে ঢুকতে হাতের বাঁয়ে সরু রাস্তায় চোখে পড়ে অজগর, বানর, পাখি শালা, সাম্বার ও চিত্রা হরিণ এবং কুমির বেষ্টনী। কিছুদূর গেলে হাতির বিচরণক্ষেত্র। হাতির পিঠে চড়ে ঘুরছেন, ছবি তুলছেন মানুষ। পাশে জলহস্তীর বেষ্টনী। সেখানে দৌড়ঝাঁপ ১০টি জলহস্তীর। পার্কের ডান দিকের বেষ্টনীতে আছে ২২টি ভালুক। বিপরীত দিকে বাঘ ও সিংহের পৃথক বেষ্টনী। সেখানে সিংহ আছে তিনটি, বাঘ আছে চারটি। সিংহ বেষ্টনীর উল্টা পাশে আরেকটি বেষ্টনীতে আছে ২০টি হরিণ। দর্শনার্থীরা হরিণের সঙ্গে বেশি সময় কাটান।

পার্কের তত্ত্বাবধায়ক মো. মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পার্কের উন্মুক্ত বনাঞ্চলে কয়েক শ হরিণ রয়েছে। এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে তিন একরের বেষ্টনীতে আছে ১৭টি হরিণ। সম্প্রতি তিনটি হরিণ বাচ্চা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এখন বেষ্টনীতে হরিণ আছে ২০টি। এর মধ্যে মায়া হরিণ ৪টি ও চিত্রা হরিণ ১৬টি। দৈনিক তিন বেলা হরিণকে খেতে দেওয়া হয় সবজি, কলা, গাজর ও ভুসি।

টানা দুই বছর ধরে হরিণের রক্ষণাবেক্ষণ করেন পার্কের কর্মী মামুন মিয়া (২৮)। হরিণগুলো তাঁকে আপনজন মনে করে। সব সময় চারপাশ ঘিরে ধরে। কলা কিংবা গাজর দেখালে হরিণগুলো লাফালাফি শুরু করে। ফটকে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা হরিণের মায়ায় জড়িয়ে পড়েন। মামুন মিয়ার উপস্থিতিতে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা বেষ্টনীতে ঢুকে হরিণের সঙ্গে ছবি তোলে, ধারণ করে ভিডিও চিত্র।

মামুন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন পার্ক ভ্রমণে আসেন তিন হাজারের বেশি দর্শনার্থী। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার দর্শনার্থী হরিণ দেখতে আসেন। হরিণের বাচ্চাগুলো মানুষ দেখলে লাফালাফি শুরু করে।

পার্ক ঘোরার জন্য রয়েছে একটি এসি ও দুটি নন–এসি বাস। বাসে পার্ক ঘুরতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট। এসি বাসে জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা, নন–এসি বাসে ১৪ জন ৪০০ টাকা। পার্কে ৩০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে পাকা ২২ কিলোমিটার।

হরিণ দেখে মুগ্ধ গাজীপুরের গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, হরিণ দেখলে যে কারও মায়া জন্মে। পার্কে ঘোরার সময় পাকা রাস্তার দুই পাশের জঙ্গলে শত শত বানরের দৌড়ঝাঁপ ও চেঁচামেচির সঙ্গে দুটি হরিণের দেখাও মিলেছে। কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য, মুহূর্তেই হরিণ চোখের আড়াল হয়ে জঙ্গলে হারিয়ে যায়। বেষ্টনীর হরিণগুলো শান্তশিষ্ট, মানুষ দেখলেই কাছে ছুটে আসে।

পার্ক কর্মকর্তাদের ভাষ্য, পার্কের জঙ্গলে উন্মুক্ত পরিবেশে কয়েক শ মায়া, চিত্রা, সাম্বারসহ কয়েক প্রজাতির হরিণ রয়েছে। কিন্তু এগুলোর গণনা হয়নি। গত ১০ বছরে হরিণের মৃত্যুর নজির নেই। বরং হরিণের প্রজনন বাড়ছে। হরিণ বছরে একবার বাচ্চা প্রসব করে। তৃণভোজী হরিণের স্বভাব দলবদ্ধভাবে বসবাস করা। প্রকৃতি কিংবা বনজঙ্গলে হরিণ বাঁচে ৯ থেকে ১৩ বছর। আর বেষ্টনী কিংবা আবদ্ধ অবস্থায় বাঁচে ১৮ থেকে ২২ বছর। প্রজননঋতুতে (জানুয়ারি-জুলাই) হরিণের মাথায় শিং গজায় এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তা আবার খসেও পড়ে। বেষ্টনীতে থাকা হরিণের ওজন ৬ থেকে ৭৫ কেজি।

স্ত্রী, তিন সন্তান নিয়ে পার্ক ঘুরতে আসেন ঢাকার মুগদাপাড়ার ব্যবসায়ী মামুনুর রশিদ। সন্তানদের হাতির পিঠে চড়িয়ে তাঁরা হেঁটে বাঘের বেষ্টনীতে আসেন। সেখানে জয়-জ্যোতি নামের দুটি বাঘ দেখে ফেরেন হরিণ বেষ্টনীতে। মামুনুর রশিদ (৪৫) বলেন, পুরো পার্কজুড়েই যেন হরিণের রাজত্ব। প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে গেলেই দেখা মেলে চিত্রা, মায়া, সাম্বর ও প্যারা হরিণের। পিচঢালা পথে এক বেষ্টনী থেকে অন্য বেষ্টনীতে যেতে সামনে পড়ে যায় শাবকসহ মা হরিণের দৌড়ঝাঁপ। পার্কের জলাশয়ের ধারে নির্ভয়ে ঘাস ও লতাপাতা খেতে আসে প্যারা হরিণ। সুত্র: প্রথম আলো

পর্যটন-এর আরও খবর