উখিয়া-গুনদুম করিডর বন্ধ আটকা পড়েছে ৪০ হাতি

  বিশেষ প্রতিনিধি    06-03-2023    209
উখিয়া-গুনদুম করিডর বন্ধ আটকা পড়েছে ৪০ হাতি

ইনানির অরণ্যে আটকা পড়েছে ৪০ হাতি। তাদের চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষুব্ধ হাতিরা দলবেঁধে হামলা চালাচ্ছে লোকালয়ে। উখিয়ার কুতুপালং গ্রামে রোহিঙ্গা শিবিরে সরু রাস্তায় মানুষ চলাচলই দায়। সেখানে ঢুকে পড়ে এক হাতি। ২০১৮ সালের ঘটনা। মিয়ানমার থেকে এসেছিল হাতিটি। দুজন রোহিঙ্গা মেরে ফেলে। দুই ঘণ্টা তাণ্ডব চালায়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে এমন ঘটনা ঘটতে থাকে। প্রথম ছয় মাসে হাতির আক্রমণে মারা যান ১২ রোহিঙ্গা। এখন হাতির উৎপাত বন্ধে রোহিঙ্গা ও গ্রামবাসী মিলে পাহারা বসিয়েছেন।

উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৯৯টি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। রোহিঙ্গা ও গ্রামবাসী পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছেন। তাদের হাতে হাই পাওয়ার টর্চ ও সার্চলাইট। হাতির আনাগোনা দেখলেই নিজের সম্প্রদায়ের মানুষকে সতর্ক করছেন। হাতির হঠাৎ এমন খ্যাপে ওঠার কারণ তাদের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। একদা মিয়ানমার থেকে গুনদুম হয়ে উখিয়া, ইনানি, টেকনাফ, সাঙ্গু, মাতামুহুরি পর্যন্ত ছিল অভয়ারণ্য। নির্বিঘ্নে সেখানে ঘুরে বেড়াত হাতির দল। পুরো এলাকা ছিল বন বিভাগের অধীনে। এখন সেই বনের জায়গায় গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প, সীমান্ত সড়ক, মিয়ানমারের কাঁটাতারের বেড়া। এসব কারণে হাতির চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

আটকে পড়া ৪০টি হাতির ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত। তাদের চলাচলের পথ খোলা না হলে হাতিগুলো বিলুপ্ত হতে পারে। কারণ, প্রজননের জন্য অধিক হাতির মিশ্রণ দরকার। কিন্তু সেই সুযোগ তারা পাচ্ছে না। ৪০টি হাতি নিজেদের মধ্যে মিলিত হচ্ছে, যা হাতির স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। হাতির খাবার সংগ্রহের জন্য বিচরণ ক্ষেত্রের পরিমাণ ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে ১২ হাজার বর্গকিলোমিটার হওয়া প্রয়োজন। বাস্তবে তা না পেয়ে ধীরে ধীরে তারা বিলুপ্ত হতে পারে।

উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত আইইউসিএন কর্মকর্তা মোহাম্মদ সুলতান আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে আমরা ২০১৮ সালে মানুষ ও হাতির সংঘাত দূর করার চেষ্টা শুরু করি। প্রথমে আমরা হাতির সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টা করলাম। ইনানি থেকে টেকনাফ পর্যন্ত কী পরিমাণ হাতি রয়েছে, সেগুলো নির্ণয়ের চেষ্টা করি। সেখানে ৪০টি হাতি রয়েছে। ২০১৬ সালে আইইউসিএন হাতির পপুলেশন রিপোর্ট বের হয়, যা রোহিঙ্গা ঢলের কিছুদিন আগে সম্পন্ন হয়।

তখন ইনানি থেকে টেকনাফ, সাঙ্গু, মাতামুহুরি পর্যন্ত হাতির পপুলেশন পর্যালোচনা করা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট হাতির সংখ্যা ২৬৮। তার মধ্যে কক্সবাজারের দক্ষিণে আছে ৬৫। তিনি বলেন, ‘হাতি ও মানুষের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে আমরা কাজ শুরু করি। রোহিঙ্গা শিবির একটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এখানে হাতি আসা যেমন বিপজ্জনক; তেমনই মানুষও হাতির কবলে পড়া বিপজ্জনক। রোহিঙ্গা শিবিরে এমন জায়গাও আছে, যেখানে মানুষ হাঁটাই কষ্টকর। সেখানে হাতি যদি ঢুকে যায় তবে মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।’

আইইউসিএন কর্মকর্তা বলেন, ‘হাতির বসতি কোথায় আছে, সেটা খুঁজে বের করি। আমরা ইউএনএইচসিআর-এর তহবিলে তৈরি করি হাতির মনিটরিং ওয়াচ টাওয়ার। টেকনাফ পর্যন্ত ৯৯টি ওয়াচ টাওয়ার করা হয়েছে। কমিউনিটির লোকেরা রাতে পাহারা দেন। তবে ক্যাম্প এলাকায় রোহিঙ্গারাই পাহারা দেন।’

তিনি বলেন, ‘এসব পদক্ষেপ নেওয়ার পর হাতির আক্রমণে আর কোনো রোহিঙ্গা মারা যাননি। আমরা কমিউনিটিকে রক্ষা করেছি। আগে হাতি এলে মানুষ ডিস্টার্ব করত। এখন আমরা প্রশিক্ষণ দিয়েছি ভদ্রভাবে হাতিকে বনের দিকে কীভাবে বিতাড়িত করা যায়। শেরপুর কিংবা অন্যান্য এলাকায় আগুন দিয়ে, ঢিল দিয়ে হাতি তাড়ানো হয়। চোখা যন্ত্র দিয়ে তাড়ানো হয়। এতে হাতি খুব বিরক্ত হয়। একটা বাঘ রেগে গেলে একজন মানুষকে কামড়ে ধরে নিয়ে যায়। হাতি রেগে গেলে মানুষ মারার পাশাপাশি ঘরবাড়ি, ফসলহানি ঘটায়। আবার হাতি খুব ভদ্র। ভদ্রভাবে তাড়ালে সমস্যা হয় না।’

সুলতান আহমেদ জানান, রোস্টার মোতাবেক কমিউনিটির লোকেরা রাতে টাওয়ারে জেগে থাকবে। হাতি আসে কি না, তা সার্চলাইট দিয়ে সারাক্ষণ আশপাশে দেখবে। হাতি কোনো বাধা দেখলে শব্দ করে। হাতি এমনিতেও চলাচল করলে আশপাশে কিছু ভাঙবেই। এটা তার আচরণ।

তার একটা শব্দ এমনিতেই আছে। সেটা কমিউনিটির কাছে পাঠানো হয়। করিডর ক্যাম্প হয়েছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে ‘সীমান্ত সড়ক’ হয়েছে। মিয়ানমার কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে। বিষয়টা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনা করা প্রয়োজন বলে আইইউসিএন কর্মকর্তা মনে করেন। উখিয়া উপজেলার কুতুপালং গ্রামে যে রোহিঙ্গা শিবির রয়েছে, তা বিশ্বের সর্ববৃহৎ শরণার্থীশিবির। কুতুপালং গ্রামে মোট ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প রয়েছে, যা কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা।

সারাদেশ-এর আরও খবর