ইফতারসামগ্রী মধ্যবিত্তদের ‘ভাবাচ্ছে’

  বিশেষ প্রতিনিধি    16-03-2023    207
ইফতারসামগ্রী মধ্যবিত্তদের ‘ভাবাচ্ছে’

দুয়ারে কড়া নাড়ছে রমজান মাস। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে মার্চের ২৩ অথবা ২৪ তারিখ থেকে শুরু হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর সিয়াম-সাধনার মাস। ইফতারে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ খেজুর, শরবত, ছোলা-মুড়ি, ফলমূল ইত্যাদি খেয়ে রোজা ভেঙে থাকেন। তবে এবছর সব ধরনের ইফতারসামগ্রীর দাম অনেকটা নাগালের বাইরে থাকায় মধ্যবিত্তরা পড়েছেন বিপাকে। অস্বাভাবিক দামবৃদ্ধি ‘ভাবাচ্ছে’ তাদের।

রোজায় প্রতি বছরই খেজুরের দাম বাড়ে। তবে, এবার বেড়েছে অস্বাভাবিক। বছরজুড়ে খেজুর কম খাওয়া হলেও রোজা এলেই এই ফলের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। আর এই সুযোগটি লুফে নিতে ভুল করে না ব্যবসায়ীরা। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় রমজানে খেজুরের চাহিদা অধিক থাকে বলে প্রতি বছরের এই সময় পণ্যটির দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকে। এজন্য অবশ্য অজুহাত দেখাতে ছাড়েন না ব্যবসায়ীরা।

রাজধানীর পাইকারি আড়ৎ বাদামতলীতে দেখা যায়, খেজুরের দাম খুব বেশি বেড়েছে। গেল এক মাসে পাইকারিতেই মানভেদে কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এখানে এক কেজি মিশরের মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ১২০০ টাকা। আর খুচরা বাজারে এটার দাম ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। মাস ব্যবধানে মেডজুল খেজুরের দাম বেড়েছে কেজিতে কমপক্ষে ১০০ টাকা। একইভাবে বেড়েছে অন্যান্য খেজুরের দামও। ইরানের মরিয়ম খেজুর ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা। দাবাস, ফরিদা ও জিহাদি খেজুরের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা।

আমদানিকারকরা বলছেন, ডলারের বাড়তি দামের সঙ্গে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক, ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট; পাঁচ শতাংশ অগ্রিম আয়কর, চার শতাংশ আগাম বাণিজ্য শুল্ক, জ্বালানির দামবৃদ্ধিতে জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি— সব মিলিয়ে খেজুরের নাগাল পাওয়া মুশকিল!

তাদের দাবি, ডলার সংকটে এলসি খোলা যাচ্ছে না। তাই আমদানিতে সৃষ্ট জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসবও খেজুরের দামবৃদ্ধির কারণ ধরা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চাহিদার তুলনায় খেজুরের আমদানি কমেছে প্রায় অর্ধেক হারে। রোজায় খেজুরের চাহিদা থাকে ৫০ হাজার টনের মতো। গত তিন মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ২২ হাজার টন। যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৬ শতাংশ কম। খেজুর উৎপাদন হয় এমন ৪০ দেশ থেকে বছরে আমদানি হয় ৩০ রকমের কমপক্ষে ৫০ হাজার টন খেজুর। শুধুমাত্র রোজার বাজারেই বিক্রি প্রায় ২৫ হাজার টন খেজুর। অবশ্য, জানুয়ারিতে ২৯ হাজার টন খেজুর আমদানির এলসি খোলা হয়েছে।

এদিকে, রমজানে ইফতারের অন্যসব জনপ্রিয় খাবারের দামও বেড়েছে। ইফতারি তৈরিতে সাধারণত ছোলা, অ্যাঙ্কর ডাল ও বেসন বেশি ব্যবহার হয়। রোজার প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও এরই মধ্যে বেড়ে গেছে এসব পণ্যের দাম। গত এক মাসে ছোলার দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা। সপ্তাহখানেক আগে ছোলার কেজি ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। মানভেদে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। পিছিয়ে নেই অ্যাঙ্কর ডাল। একই সময়ে এ ডাল কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ ছাড়া, বেসনের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।

গরমের সময় রোজা হওয়াতে ইফতারের সময় শরবতের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ, সারাদিনের তৃষ্ণা মেটাতে সবাই শরবত পান করেন। শরবতের তৈরির অন্যতম জিনিস হলো চিনি। কিন্তু গত ছয় মাসে চার বার দাম বাড়ানোর পরও চিনির বাজারের অস্থিরতা থামেনি। বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া, লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দামে। সরকারি হিসাবে গত এক বছরে চিনির দাম প্রায় ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। বিক্রেতারা বলছে, রমজানের চিনির দাম আরও বাড়তে পারে।

রমজানের ইফতারে ফল রাখার চেষ্টা করেন সবাই। তবে এ বছর বাড়তি দামের কারণে ইফতারে ফল রাখতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা। এখন বাজারে ক্রাউন আপেল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। গত বছর এর দাম ছিল কেজি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা। ফুজি আপেল বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। মিশরের মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকা।

ইন্ডিয়ান সাদা আঙুর বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৩৫০ টাকায়। চায়না কমলা বিক্রি হচ্ছে ২৬০ টাকা থেকে ২৮০ টাকা। গ্রিন কমলা বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়। এছাড়া মাঝারি সাইজের একটি আনারস খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। এই আনারস গতবছর এই সময়ে ৪০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।

রমজানের ইফতারসামগ্রীর কিনতে আসা এক গৃহিণী জানান, সবকিছুর দাম বেশি। আগে যে খেজুর কিনছি ৩০০ টাকায়, আজ সেটা ৬০০। এছাড়া ফলমূল, চাল-ডাল, তেল-সবজি, সবকিছুর দাম বেশি। আমাদের মত মধ্যবিত্ত পরিবারে এবার রমজানে অনেক সমস্যা হবে। চাহিদা অনুযায়ী সবকিছু নিতে পারছি না। কারণ আয় বাড়েনি, অথচ সব পণ্যের দাম বাড়তি।

আবুল কালাম ভূঁইয়া নামে এক বেসরকারি চাকরিজীবী জানান, নিউ মার্কেট বাজার করতে আসি একটু কম দামে পাব বলে। এসে দেখি সবকিছুর দাম বাড়তি। পরিবারে ছয় জন সদস্য। তাদের নিয়ে এবার ইফতার একটু ভালো করার উপায় নেই। এমন কোনও জিনিস নেই যে দাম বাড়েনি। যা বেতন পাই, ঘরভাড়া দিয়ে সংসার চালানোই কঠিন। পত্রিকায় দেখি মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমে, আর এদেশে বাড়ে।

নিউ মার্কেটের মুদিদোকানি হাসান মিয়া বলেন, রমজানের আগে যেভাবে সব পণ্যের দাম বাড়ছে; এতে করে আমাদের মত মধ্যআয়ের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি। কারণ, সাধারণ মানুষের অভিযোগ আমাদের বেশি শুনতে হয়। এদিকে মোকামের মহাজনরা বলেন, তারা ডলার সংকটের কারণে মাল আনতে পারেন না।

নিউ মার্কেট সমবায় বণিক সমিতির সভাপতি হাবিবুল্লাহ পাঠান বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি দোকানে বলে দিয়েছি যাতে নির্ধারিত দামের বেশি দামে কোনও পণ্য বিক্রি না হয়। এছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার ইফতারসামগ্রী দাম একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। যারা অন্যতম কারণ হলো ডলার সংকট। আমাদের কাছে কোনও ক্রেতা অভিযোগ করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’

জাতীয়-এর আরও খবর