যে পুরুষ অলজ্জ দৃষ্টিতে মেয়ে দেখে, তাকে দখল করতে চায় না

বিশ্বজিৎ রায়

  বিশেষ প্রতিনিধি    08-09-2022    141
যে পুরুষ অলজ্জ দৃষ্টিতে মেয়ে দেখে, তাকে দখল করতে চায় না

নারী আর রানী শব্দ দুটোকে উলটেপালটেই নাকি প্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘নীরা’ নামের মেয়েটির গড়ে তুলেছিলেন। সে অনেক দিন আগেকার কথা: ১৯৬২ নারী আর রানী শব্দ দুটোকে উলটেপালটেই নাকি প্রয়াত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘নীরা’ নামের মেয়েটির গড়ে তুলেছিলেন। সে অনেক দিন আগেকার কথা: ১৯৬২। সুনীল তখন তিরিশের নীচে, কেরানিগিরির চাকরি পেয়েছেন সবে। নারী ও রানি কোনওটিই মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে লভ্য নয়। বেকারজীবনের স্বাদ-আহ্লাদ, হতাশা-ভালবাসার স্বাধীনতা এই সদ্য চাকরির দশটা-পাঁচটা মুছে দিতে পারেনি। সেই সময়েই লেখা নীরাকে নিয়ে প্রথম কবিতা। ‘বাসস্টপে দেখা হল তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল/ স্বপ্নে বহুক্ষণ/ দেখেছি... নীরা’ মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকের মেয়ে দেখার এই পদ্যখানি এর পর ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সুনীলের কবিতায় নানা অনুষঙ্গে পরের সুদীর্ঘ বছরগুলিতে মাঝে মাঝে নীরা ফিরে আসে, ২০১২ পর্যন্ত। পঞ্চাশ বছর ধরে সুনীল নীরাকে নানা ভাবে দেখলেন, দেখালেন। কবির বয়স হল, যে মন নীরাকে দেখেছিল সেই মনটির বয়স অনতি তিরিশ। বঙ্গদেশ এই পঞ্চাশ বছর অনেক কিছু দেখেছে। নকশাল আন্দোলন, বাম জোটের ক্ষমতা লাভ, অপারেশন বর্গা, বামপন্থার সুবিধেবাদী মধ্যবিত্তপনায় রূপান্তর, মুক্ত অর্থনীতির প্রসার, মুক্ত অর্থনীতির হাত ধরে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নিষেধাজ্ঞার জানলা দরজা খুলে যাওয়া এই সব ঘটে গেছে এই পঞ্চাশ বছরে। আর এ-সবের সঙ্গে বদলে গেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি যুবকদের মেয়ে দেখার চোখ ও চাহিদা। ‘মেয়ে দেখা’ শব্দটি কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশেষ অর্থবহ, লোডেড টার্ম। যে পুরুষতান্ত্রিক বাঙালি সমাজ দেখে শুনে, সাজিয়ে বাজিয়ে, চুল খুলিয়ে হাঁটিয়ে, সুশ্রী গৃহকর্মনিপুণা মেয়েকে বিয়ের যোগ্য পাত্রী বলে স্থির করে তারা পাত্রী নির্বাচন করতে যাওয়াকে চলিত বাংলায় ‘মেয়ে দেখা’ বলে। আবার রকে বসে, দু’চাকায় চেপে যে বাঙালি যুবকেরা মেয়েদের বিরক্ত করে অবলোকন-কাম চরিতার্থ করে তারাও ‘মেয়ে দেখে’। বিবাহতন্ত্রে ও রকবাজিতে মেয়ে দেখা এক দিক থেকে এক রকম। দুইই মেয়েকে নিছক বস্তু হিসেবে গণ্য করে। আমি ইচ্ছে মতো চুল খুলে হাঁটাব, আমি ইচ্ছে মতো সিটি দেব, টিটকিরি, হাত ধরে টানাটানি। এখন খবরের কাগজ খুললে আরও বেশি কিছু চোখে পড়ে। কথা না শুনলে অ্যাসিড, সহবাসের পর মগ্ন-নগ্ন মুহূর্তের ছবি সাইবার স্পেসে, আর ধর্ষণ তো রয়েছেই। এ কাজ পুরুষেরা একা ও অনেকে মিলে করতে ভালবাসে, দেখতেও। প্রতিটি ক্ষেত্রে মেয়েটি নিতান্ত কর্ম, অবজেক্ট। তার কোনও স্বাধীন ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। এই সব ঘটনার সূত্রে মনে হয়, পুরুষের পক্ষে যা খুব ‘স্বাভাবিক’, ‘অনিবার্য’ নারীসৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ অলজ্জ দৃষ্টি তা যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। অধিকার ও দখল করতে না চেয়ে মগ্ন ভাবে নারীসৌন্দর্য দর্শন, এরই কবিতা কিন্তু সুনীলের নীরাকে নিয়ে লেখাগুলি। ষাট সত্তরে বাঙালি জীবনে মেয়েদের আর ছেলেদের জগৎ এখনকার মতো খুব কাছাকাছি ছিল না। তবে সুনীল যে কবিগোষ্ঠীর নায়ক ছিলেন তাতে শিক্ষিত সহজ মেয়েদের উপস্থিতি ছিল। পুরুষদের মতো মেয়েদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন কবিতা সিংহ। কৃত্তিবাসের পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘আমার পুরুষ বন্ধুরা’র মতো লেখা। সে লেখায় নানা ছবি। দলবদ্ধ পুরুষদের সঙ্গে মগ্ন সুন্দর জঙ্গলে গিয়েছিলেন মেয়ে, সেই একটি মাত্র স্ত্রীলোক। সেখানে নদী ছিল। হঠাৎ খেয়াল হল বন্ধু পুরুষদের, সবাই নদীতে নগ্ন স্নান করবে। অতএব মেয়েটিকে ‘করুণ অনুরোধ, কিছুক্ষণ পিছন ফিরে বসে থাকতে হবে। তাই-ই হল। স্নানের আনন্দরোল শুনলাম। হাসি। জলের শব্দ।’ দাম্পত্যের বা পারিবারিকতার অধিকার, রকবাজের প্রতাপএর বাইরে এই পারস্পরিক বন্ধুতার জগৎ ছিল বলেই সুনীল সেই সময়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গে নীরাকে নিয়ে সাবলীল স্বীকারোক্তির কবিতাগুলি লিখতে পেরেছিলেন। মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে বৈপ্লবিক। নীরা জীবনানন্দের বনলতার মতো ইতিহাসে থাকে না, কলকাতার নিত্যদিনে থাকে। তবু নীরার কবিতাগুচ্ছে কখনওই মেয়েটিকে জোর করে অধিকার করতে চাননি কবি। কলকাতা শহরের পথচলতি নানা পরিসরে দেখেছেন তাকে। লিখেছেন, ‘নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়ল।’ বোঝা যায় নানা নারীর মধ্যে হঠাৎ তিনি নীরাকে দেখে ফেলেন। দোল ও সরস্বতী পুজোয়, লাইব্রেরির মাঠে, চৌরাস্তায় ট্যাক্সি খোঁজাখুঁজির সময়। এবং এই পুরুষ তার স্বপ্নে নীরাকে দেখেন শয্যায়। তাঁর কবিতার ‘প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাস রেফ্’ নীরার ‘আধোঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও / বিছানায়’ ঘুরতে থাকে। কিন্তু ‘তুমি ভয় পেয়ো না’ স্বীকারোক্তি করেন পুরুষটি। কারণ নীরা পুরুষটিকে ‘লোভহীন’ করে ফেলেছে। বলেছে সে, ‘যেই দরজা খুললে আমি জন্তু থেকে মানুষ হলাম’। ‘তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত পাপমুক্তি’। ‘এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ/ আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি?... আমি ডান হাত তুলি, পরুষ পাঞ্জার দিকে/ মনে মনে বলি,/যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো। সুনীল নারীবাদী লেখক নন। সারাজীবন পলিটিক্যালি কারেক্ট ছিলেন না। তাঁর নীরার কবিতাগুচ্ছে প্রেম ও বন্ধুতার পাশাপাশি পুরুষের লোলুপ অধিকারবোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছে বড় সুন্দর ভাবে প্রকাশিত। সেই ইচ্ছে সুনীল যে ভাষায় লিখেছিলেন তা বাঙালি পুরুষের সহজ মুখের ভাষার কাছাকাছি। সুনীলের এই কবিতাগুলি অন্তত কিছু বাঙালি যুবককে মেয়েদের অধিকার করার বস্তু হিসেবে ভাবার থেকে বিরত করেছিল। সত্তরের দশকে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ‘সামনে চামেলি’ নামে একখানি গল্প লিখেছিলেন। সে বেশ জটিল গল্প। সাতাশে পা দেওয়া এক যুবকের কথা। সে গরিব, ভীরু, খোঁড়া, লাজুক তবু যুবক। কলকাতার পথে টুকটুক করে যেতে যেতে সে অপরূপ মেয়েদের দেখে। ‘তাদের প্রত্যেকটিকে একদা আমি লাভ করব এমন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখতে’ তার ‘একটুও বাধেনি’। গল্পটা লাভ করার নয়। শেষ পর্যন্ত পুরুষটি লাভ ও দখলের বদলে ভিখিরির মতো এগিয়ে চলে, ‘সামনে কোথাও চামেলি ফুটেছে’। তাঁর নীরার কবিতাগুচ্ছে সুনীলও পুরুষের লাভ, লোভ, অধিকারের দাবিকে বিরত করেছেন। ২০১২‘য় লিখেছেন, ‘কে যেন নীরার হাতে/ একগুচ্ছ ফুল দিয়ে গেল...’ সুনীল মুখ্যত যে নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালিদের কথা লিখেছেন, তাদের পুরুষালি অধিকারবোধকে সরিয়ে রেখে নীরাকে দেখেছেন, সেই দেখাটা বাস্তবে বড় বিরল হয়ে উঠেছে যেন। তা রোম্যান্টিক হতে পারে, সাম্প্রতিক অকুণ্ঠ স্মার্ট পুরুষদের কাছে বোকা বোকা মনে হতে পারে, কিন্তু সেই দেখা যে অলজ্জ ভাবে দেখা, অথচ দখল করতে না চাওয়া, এই কথাটুকু জরুরি। মুক্ত অর্থনীতি অনেক সুবিধের দ্বার খুলে দিয়েছে, কিন্তু তার মধ্যে যে দখল করার অকুণ্ঠ পুরুষালিত্ব আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সুনীলের নীরার কবিতাগুচ্ছে এই ‘পুরুষালিত্ব’ নেই। সূত্র: আনন্দবাজার