কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির: আরসার বিভেদে খুনোখুনি

  বিশেষ প্রতিনিধি    14-04-2023    99
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির: আরসার বিভেদে খুনোখুনি

কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে খুনোখুনি বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) ভেতরে বিভেদ। এই বিভেদের কারণে দলছুট হচ্ছে কিছু সদস্য। তাদের প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে যোগদান এবং সংগঠনের গোপনীয়তা ফাঁস ঠেকাতে ভীতি সঞ্চারের জন্য দলছুটদের খুন করছে আরসা। সাবেক সদস্যদের দলে নেওয়ায় প্রতিপক্ষ আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেও দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে।

রোহিঙ্গা শিবিরে কর্মরত একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা, তাদের প্রতিবেদন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও থানা সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র বলেছে, গত ৩৯ দিনে বিভিন্ন শিবিরে খুন হওয়া ১৫ রোহিঙ্গার বেশির ভাগই আরসার সাবেক সদস্য। সুবিধাবঞ্চিত হয়ে তারা সংগঠনটির প্রধান আতাউল্লাহ আবু আম্মার ওরফে জুনুনির ওপর আর আস্থা রাখতে পারেনি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শিবিরে দীর্ঘদিন আরসার একক আধিপত্য ছিল। কিন্তু আরসা ছেড়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়িয়ে আরএসও অবস্থান শক্ত করেছে। এ নিয়েও দুই সংগঠনের দ্বন্দ্বে খুনোখুনি বেড়েছে।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কে আরসা, কে আরাকান আর্মি, সেটা কোনো বিষয় নয়। আমরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে দেব না। সেখানে যারাই অপরাধে জড়াবে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। কেউ ছাড় পাবে না।’

কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৩-এর মাঝি আবু সালেহ বলেন, ক্যাম্পগুলোর প্রধান মাঝি ও আরসার মধ্যে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। এ দ্বন্দ্বের অন্যতম কারণ আরসার ছায়াতল থেকে সরে আসার চেষ্টা। মাদক, অপহরণ, গুম, মুক্তিপণের টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়েও দ্বন্দ্ব ছিল। এসব কারণে আরসা অনুসারী মাঝিরা সংগঠন থেকে সরে এসেছেন।

চলতি মাসে উখিয়ার বালুখালী ৯ নম্বর ক্যাম্পে নূর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাস (৪০) নামের এক রোহিঙ্গাকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। তিনি আরসার সক্রিয় কমান্ডার ছিলেন। এপিবিএন বলেছে, ক্যাম্পের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায়ও তিনি ছিলেন। গত মাসে বালুখালী ৮-ইস্ট রোহিঙ্গা শিবিরে ‘আধিপত্য বিস্তার’ নিয়ে সশস্ত্র দুটি গোষ্ঠীর সংঘর্ষে দুই রোহিঙ্গা নিহত ও একজন গুলিবিদ্ধ হয়। তারাও আরসার সাবেক সদস্য।

১৪ এপিবিএনের অধিনায়ক ও অতিরিক্ত ডিআইজি সৈয়দ হারুন অর রশিদ বলেন, আরাকান স্যালভেশন আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ বিভিন্ন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের কারণে শুধু তারাই নয়, অনেক সাধারণ রোহিঙ্গাও নিহত হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে।

গত বুধবার রোহিঙ্গা শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হন। এপিবিএন বলছে, তিনি আরসা কমান্ডার। ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র-গুলিসহ আরসার তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আরসা-আরএসও দ্বন্দ্বের কারণ

কয়েক মাস ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় গোলাগুলি হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন বলছে, আরসা ও আরএসও সদস্যরা কোনারপাড়া শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। পরে তা রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়ছে। তমব্রু সীমান্তে শূন্যরেখায় গোলাগুলিতে আহত আরএসও সদস্য মুহিব উল্লাহর দাবি, ২০১৮ সাল থেকে টানা তিন বছর মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকায় তাঁরা অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের সংগঠনের লক্ষ্য ‘আরকানের আজাদি’। নিজের জন্মভূমিতে ফিরতে তাঁদের সশস্ত্র সংগ্রাম চলছে। অন্যদিকে আরসা চায়, রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারে না ফেরে।

আরসার সদস্য কত

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো ইউনিট মনে করে, রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার অস্তিত্ব নেই। আবার কারও কারও মতে, শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল সংগঠনটি। তবে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ খুন হওয়ায় পর আরসার অপতৎপরতার বিষয়টি উঠে আসে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলেছে, মুহিবুল্লার খুনের পর বিভিন্ন শিবির থেকে ৪৬৭ জন কথিত আরসা সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে এপিবিএন। এপিবিএন সূত্র বলছে, কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মোট ৩৪টি ক্যাম্পের সব কটিতে আরসা সক্রিয়। এর সদস্যসংখ্যা কমপক্ষে পাঁচ হাজার। তবে আরসার প্রধান গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা শিবিরে তাঁদের সদস্য ১৬ হাজারের বেশি। এখন পর্যন্ত আরসার ১০ কমান্ডারের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁরা হলেন আলি জোহর, হোসেন জোহর, জয়নাল, মো. সেলিম, আয়াত উল্লাহ, বশির উল্লাহ ও ওবাইদ উল্লাহ। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছেন আলমগীর, মৌলভি মোস্তাক, ওস্তাদ খালেদ ওরফে খালিদ ও ইব্রাহিম।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে ১৪৭ জন খুন হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই শিবিরের কমিউনিটি নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক। প্রথম দিকে আরসার জড়িত থাকা নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও সম্প্রতি দুই নেতা, তিন মাঝি, ছয় মুসল্লিসহ অন্তত দুই ডজন খুনে সরাসরি আরসা জড়িত বলে প্রমাণ মিলেছে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যাকাণ্ড আরএসওর নামও এসেছে।

কয়েকটি শিবিরের নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক হেড মাঝিরা অভিযোগ করেন, শিবিরে রাতে ভারী ও আধুনিক অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় একটি গ্রুপ। এরা প্রতিটি ব্লকে গিয়ে যুবকদের তাদের সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দিতে বলে। কাউকে কাউকে যোগ দিতে বাধ্যও করে।

রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড-সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এসবের পরও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সম্পূর্ণরূপে আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমরা সবাই মিলে দায়িত্ব পালন করছি।’ সুত্র: আজকের পত্রিকা

সারাদেশ-এর আরও খবর