উত্তপ্ত হবে রাজনীতি ঈদের পর ফের মাঠ দখলের প্রস্তুতি

ভোটের কার্যক্রম আরও জোরালো করবে আ.লীগ * আন্দোলনের গতি বাড়াবে বিএনপি

  বিশেষ প্রতিনিধি    21-04-2023    92
উত্তপ্ত হবে রাজনীতি ঈদের পর ফের মাঠ দখলের প্রস্তুতি

পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর ফের উত্তপ্ত হচ্ছে রাজপথ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি রাজপথ দখলে রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে নানা প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি বিএনপির আন্দোলন মোকাবিলা এবং অপপ্রচারের জবাব ও উন্নয়ন প্রচারে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। ঈদের পর ভোটের প্রস্তুতি আরও জোরালো করে মাঠ দখলে রাখবে ক্ষমতাসীনরা। পরিকল্পনা সাজাতে জেলা, উপজেলা ও মহানগরের নেতাদের নিয়ে বৈঠকও শুরু করেছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ক্ষমতাসীনরা যখন নির্বাচন নিয়ে তাদের রণকৌশল প্রস্তুত করছেন ঠিক সেই সময়ে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রায় শেষ করেছে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে ঈদের পর আন্দোলনের গতি বাড়াবে দলটি। মহান মে দিবসে ঢাকায় বড় শোডাউনের মধ্য দিয়ে ঈদের পর মাঠে নামছেন তারা। ওইদিন রাজধানীতে শ্রমিক মহাসমাবেশ বা র‌্যালি করার কথা রয়েছে। এরপর তৃণমূল থেকে পুনরায় সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে চায় দলটি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ বা লংমার্চ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে দখলে রাখা হবে রাজপথ। ধীরে ধীরে তা বেগবান করে সময় ও সুযোগ বুঝে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে অলআউট মাঠে নামবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সে লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে সার্বিক প্রস্তুতি।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়াসহ জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা ইস্যুতে আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের এ আন্দোলনে দিন দিন সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ বাড়ছে। শিগগিরই চলমান আন্দোলন আরও বেগবান করা হবে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যেই দেওয়া হবে কর্মসূচি। তাতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এক সময় গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেবে বলে আশা করি।

তিনি বলেন, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে আমাদের ঐক্য সুদৃঢ় হয়েছে। সবার সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। আন্দোলন দমাতে সরকার নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু এসব করে এবার তাদের পতন ঠেকাতে পারবে না।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আব্দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সাংগঠনিক কাজ চলমান আছে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনমুখী দল। আমাদের সাংগঠনিক কাজ এখনো আছে, ঈদের পরেও থাকবে। বিএনপির আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা তাদের দলের বিষয়। অনেকদিন ধরে শুনছি তারা আন্দোলন জোরদার করছে। আমরাও চাই-একটা শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক শুভশক্তির উত্থান হোক। কিন্তু কোনো অশুভ কর্মকাণ্ড বা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি কেউ যেন তৈরি না করে সেই আাহ্বানও আমরা করব।

আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি : জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আন্দোলনে আছে বিএনপি। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে তা আরও জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। তবে উচ্চ আদালতের রায়ে বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। শুধু তাই নয়, এ ইস্যুতে আলোচনা করতেও রাজি নয় দলটি। তাদের মতে, নির্বাচনের সময় নির্বাচিত সরকার অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারই দায়িত্বে থাকবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। এই অবস্থান নিয়েই আওয়ামী লীগ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে।

তিন মেয়াদে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। আগামী নির্বাচনেও জয় পেতে আগেভাগেই মাঠ গোছানো শুরু করেছে দলটি। এত লম্বা সময় ক্ষমতায় থাকায় তৃণমূলে বেড়েছে দ্বন্দ্ব। তা নিরসনে এবার সরাসরি পদক্ষেপ নিচ্ছেন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। ইতোমধ্যে জেলা, উপজেলা ও মহানগরের নেতাদের গণভবনে ডেকে কথা বলছেন তিনি। এছাড়া বেশ কয়েকটি জেলায় জনসভা করেছেন। দলীয় প্রার্থী বাছাই, জোটের মেরুকরণ মেলানো, ইশতেহার তৈরি, সদস্য সংগ্রহসহ অন্যান্য কাজও শুরু করেছে। ঈদের পর এসব কর্মসূচিতে গতি বাড়াবে দলটি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হচ্ছে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রির পর দলীয় প্রার্থীও চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ। পাঁচ সিটির মধ্যে-গাজীপুর ও বরিশালে প্রার্থী পরিবর্তন করেছে দলটি। সিলেটে দিয়েছে নতুন মুখ। আর রাজশাহী ও খুলনায় বর্তমান মেয়রদেরই আবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে আগে বড় শহরগুলোর এই ভোটে সব মনোনয়নপ্রত্যাশী এবং দলীয় নেতাকর্মীদের নৌকার পক্ষে মাঠে নামানোই চ্যালেঞ্জ আওয়ামী লীগের। এ নিয়ে কাজও শুরু করেছে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা। ইতোমধ্যে তারা নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন।

ঈদকে সামনে রেখে ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে ভিডিওকলে যুক্ত হয়ে বুধবার শুভেচ্ছা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঈদের ছুটিতে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরে জনসংযোগ করার পাশাপাশি সরকারি প্রকল্পের উপকারভোগীদের খোঁজখবর নিতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন তিনি। এ সময় শেখ হাসিনা তাদের গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে যেতে বলেছেন। একই সঙ্গে বিএনপির আমলের অপশাসন দুর্নীতি চিত্র এবং পার্থক্য মানুষের সামনে তুলে ধরার কথা বলেন। দলীয় সংসদ-সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলাকায় কোনো দলাদলি করা যাবে না। মনোনয়ন দেব আমি। যারা মনোনয়ন পেতে আগ্রহী, সবাই এলাকায় একসঙ্গে কাজ করবে। কোনো ধরনের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া যাবে না।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গণতন্ত্রের মানবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার নেতাকর্মীদের বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা কর্মী হিসাবে তার নির্দেশনা পালন করলে শুধু সিটি নির্বাচন নয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সব অপশক্তিকে মোকাবিলা করতে পারব।

বিএনপির আন্দোলনের প্রস্তুতি : সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের পরিকল্পনা প্রায় শেষ করেছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এরই অংশ হিসাবে ঈদের পর আন্দোলনের গতি বাড়াবে দলটি। মহান মে দিবসে ঢাকায় বড় শোডাউনের মধ্য দিয়ে মাঠে নামছেন তারা। ওইদিন রাজধানীতে শ্রমিক মহাসমাবেশ বা র‌্যালি করার কথা রয়েছে। এরপর তৃণমূল থেকে পুনরায় সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে চায় দলটি। ঢাকা থেকে বিভিন্ন বিভাগ অভিমুখে রোডমার্চ বা লংমার্চ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। এভাবে ধারাবাহিক কর্মসূচি দিয়ে দখলে রাখা হবে রাজপথ। ধীরে ধীরে তা বেগবান করে সময় ও সুযোগ বুঝে সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে অলআউট মাঠে নামবে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। সে লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে সার্বিক প্রস্তুতি।

বিএনপির নীতিনির্ধারকরা জানান, রাজপথে নামার আগে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা হচ্ছে। কিছু বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে থাকা দূরত্ব মেটাতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন তারা। শিগগিরই মান-অভিমান মিটে যাবে। সব দলের মতামতের ভিত্তিতে অভিন্ন দাবি নিয়ে চূড়ান্ত করা হচ্ছে ঘোষণাপত্র। শিগগিরই যৌথভাবে তা ঘোষণা করা হবে।

বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, চলমান আন্দোলনে যাতে স্থবিরতা না আসে সেজন্য পবিত্র রমজান মাসেও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। রোজার মধ্যেই দেশের ১৩ মহানগরসহ ৭৯ সাংগঠনিক জেলা ও সাড়ে ছয়শ থানা-উপজেলায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। ১১ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশের অধিকাংশ ইউনিয়নে পালন করা হয় অবস্থান, মানববন্ধন ও গণসংযোগ কর্মসূচি। এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রমজানেও নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত রাখা হয়।

মাঠের কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি পহেলা রমজান থেকে এ পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কেন্দ্র ও তৃণমূলের অন্তত ৫০টি আলোচনা সভা ও ইফতার পার্টিতে অংশ নেন। একদিনে একাধিক অনুষ্ঠানেও বক্তব্য রাখেন তিনি। তার বক্তব্যের প্রায় পুরোটাই ছিল রাজপথের আন্দোলনকেন্দ্রিক। রাজপথে কঠোর আন্দোলন করতে হবে নেতাকর্মীদের এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। এর আগে সাড়ে ৩ হাজার ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে হাইকমান্ড। এসব বৈঠকেও স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের পরামর্শ দেন।

জানা গেছে, আগামী দিনে রাজপথে আন্দোলনের বার্তা নিয়ে ঈদে নেতাদের এলাকায় পাঠানো হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে ওই আন্দোলনে শরিক হতে তাদের কাজ করতে বলা হয়। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল যুগান্তরকে বলেন, সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে আমরা সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন পাচ্ছি। বিগত সময়ে বিভাগীয় গণসমাবেশ এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে নানা কর্মসূচিতেও তাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপির দাবিগুলো জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বলেই তারা আমাদের সমর্থন জানাচ্ছে।

তিনি বলেন, যে কোনো আন্দোলনের একটা কৌশল থাকে। দিনক্ষণ ঠিক করে কখনো চূড়ান্ত আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া যায় না। অতীত ইতিহাস তাই বলে। ঈদের পরে চলমান আন্দোলনের গতি আরও বাড়ানো হবে। সময় ও সুযোগমতো তা সরকার পতনের একদফায় রূপ নেবে।

বিএনপির এ নেতা বলেন, আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে এবার আমরা বেশ সতর্ক। আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে বা স্তিমিত করতে সরকার নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে পারে। কিন্তু এবার সরকারের কোনো ফাঁদে পা দেব না। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাজপথেই থাকব। বিএনপির এ আন্দোলন একপর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ পাবে। গণআন্দোলনে সরকার বিদায় নিতে বাধ্য হবে।

জাতীয়-এর আরও খবর