স্বজনদের দাবি এফবি কালু ট্রলারটি হোয়ানকের, ওরা জেলে ডাকাত নয়

  বিশেষ প্রতিনিধি    25-04-2023    81
স্বজনদের দাবি এফবি কালু ট্রলারটি হোয়ানকের, ওরা জেলে ডাকাত নয়

কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক এলাকার ভেসে আসা এক ট্রলার থেকে ১০টি মরদেহ উদ্ধার করেছেন থানা পুলিশ। ওই ট্রলারের হিমঘর থেকেই মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। সকলের হাত-পা বাঁধা অবস্থায়। ধারণা করা হচ্ছে, সাগরে তাদের হত্যা করে হাত পা বেঁধে হিমঘরের মুখ আটকে দেয়া হয় এবং অক্সিজেনের অভাবে সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।

রবিবার (২৩ এপ্রিল) সকালে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় ভেসে আসা ট্রলারে মাছ আছে কি না তা দেখতে গেলে হিমঘরের মুখ খুলতেই মানুষের হাতের অংশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ওই ১০টি মরদেহ উদ্ধার করে।

কক্সবাজার সদর থানার অফিসার ইনচার্জ রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ট্রলার থেকে উদ্ধার করা মরদেহগুলো পচে-গলে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দেখে চেনার কোন উপায় নেই। তবে ট্রলার ও মরদেহ শনাক্তের চেষ্টা চলছে। ট্রলারে আর কোন মরদেহ আছে কি না তাও গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।

ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (কক্সবাজার) অতীশ চাকমা বলেন, এটি দুর্ঘটনা নয়। মরদেহের হাত-পা বাঁধা ছিল। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ৮/১০ দিন আগে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে।

কক্সবাজার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাকারিয়া জানান, বঙ্গোপসাগরে ট্রলারটি ভাসতে দেখে জেলেরা কূলে নিয়ে আসে। তারপর মরদেহ দেখতে পেয়ে তাঁরা পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন মরদেহগুলো উদ্ধার করে।

এদিকে সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে উদ্ধারকৃত ট্রলার ও মরদেহ শনাক্ত করা না গেলেও ওই ট্রলারটি মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়া গ্রামের শামসুল আলমের মালিকানাধীন ট্রলার বলে দাবী করেছেন তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম জানান, ৭ এপ্রিল মাঝিমাল্লাদের নিয়ে তার স্বামী শামসুল আলম সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। দীর্ঘদিন ফিরে না আসায় তিনি বিষয়টি প্রশাসন ও সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। রবিবার কক্সবাজারে ট্রলারে মরদেহ উদ্ধারের খবর শুনে ছুটে এসেছেন তিনি এবং ট্রলারটি তার স্বামীর ট্রলার বলে শনাক্তও করেছেন।

তিনি আরও জানান, তার এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। ছেলের নাম অনুসারে ট্রলারের নাম রাখা হয় এফবি কালু। কিন্তু সাগরে যাওয়ার আগে ট্রলার মেরামতের কাজ করার সময় নামটি মুছে যায়, পরে আর নামটি লিখা হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শামশুল আলমের ট্রলারে তিনি সহ ১১ জন মাঝিমাল্লা ছিলেন। তাদের কেউ বাড়ি ফিরে আসেনি এবং তাদের সাথে পরিবারের কারো যোগাযোগও নেই। নিখোঁজ ওই ট্রলারে মহেশখালীর ৮ জন এবং চকরিয়ার ৩ জন জেলে ছিলেন।

তারা হলেন— মহেশখালী উপজেলার হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়া গ্রামের আবু জাফরের পুত্র শামশুল আলম, মোহাম্মদ মুসা ও শাপলাপুর ইউনিয়নের মিটাছড়ি গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের পুত্র সাইফুল ইসলাম (১৮), জাফর আলমের পুত্র সওকত উল্লাহ (১৮), মুসা আলীর পুত্র ওসমাণ গনি (১৭), শাহাব মিয়ার পুত্র সাইফুল্লাহ (২৩), মোহাম্মদ আলীর পুত্র পারভেজ মোশাররফ (১৪), মোহাম্মদ হোসাইনের পুত্র নুরুল কবির (২৮) এবং চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ইউনিয়নের কবির হোসাইনের পুত্র সাইফুল ইসলাম, শাহ আলমের পুত্র শাহজাহান (৩৫), জসিম উদ্দীনের পুত্র তারেক (২৫)।

নিখোঁজ থাকা জেলে নুরুল কবিরের পিতা মোহাম্মদ হোসেন জানান, তার ছেলে দিনমজুর। সাগরে মাছ ধরা, ঝালমুড়ি বিক্রি, দৈনিক মজুরি খাটা সহ যে কাজ পান তা করে জীবন চালায়। ৭ এপ্রিল তার ছেলে নুরুল কবির সহ একই এলাকার আরো ৫ জন ট্রলারে করে মাছ ধরতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। সাগরে তাদের বোটে হামলা হয়েছে বলে তিনি লোকমুখে শুনেছেন। এ ঘটনা প্রকাশের পর তার ছেলের সাথে যাওয়া অপর ৫ জনের পরিবার তাদেরকে বিভিন্নভাবে চাপ দিচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

কি ঘটেছিল নিখোঁজ ট্রলারের মাঝিমাল্লাদের সাথে:

মহেশখালী উপজেলার বাবু মনি নামের এক জেলে সাগরে মাছ ধরা শেষে এলাকায় ফিরে জানান, গত ৯ এপ্রিল সকালে তারা সাগরে মাছ ধরছিল। ওই সময় কয়েকটি ট্রলার অপর একটি ট্রলারকে ডাকাত তকমা দিয়ে ধাওয়া করছিল। করিম সিকদার মাঝি নামের এক বোটের মাঝি ওই ট্রলারকে ধাওয়া করার জন্য বাবু মনিদের বোটকে আহ্বান করে। তবে বাবু মনিদের বোটের মাঝি সেই ডাকে সাড়া না দিয়ে কূলে ফিরে আসে।

তিনি আরো জানান, সেইসময় মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ির বাইট্যা কামাল ও তার ভাই নুর হোসাইন বহদ্দারের দুটি বোট এবং আবছার মাঝি ও বাবুল মাঝির দুটি বোট ওই ট্রলারকে ধাওয়া করে সাগরের দিকে চলে যায়। তারপর কি ঘটেছে তিনি তা জানেন না।

এলাকায় লোকমুখে যা প্রচার হয়:

শামশু মাঝির ট্রলারটি নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে লোকমুখে বিভিন্ন তথ্য প্রচার হতে থাকে। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের বরাত দিয়ে অনেকেই জানান, ডাকাত সন্দেহে একটি ট্রলারকে ধাওয়া করে কয়েকটি ট্রলার। তারা ট্রলারটি আটক করে মাঝিমাল্লাদের মারধর করে। তারপর সবাইকে বেঁধে কোল-স্টোরে (হিমঘরে) ঢুকিয়ে তার মুখ আটকে দেয়। তবে সেই সময় ওই তথ্যকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন অনেকে। কিন্তু স্বজনরা নিখোঁজদের খোঁজ পেতে প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে। ট্রলারসহ ১০ মরদেহ উদ্ধারের পর এই ঘটনাটি আলোচনা উঠে আসে আবারও

নিখোঁজ জেলেদের ব্যাপারে যা বলছে এলাকাবাসী:

শাপলাপুর ইউনিয়নের মিটাছড়ি ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সলিম উল্লাহ জানান, তার এলাকা থেকে ৬জন নিখোঁজ হয়েছে। তাদের ৫জনের বয়স ১৬ বছরের নিচে। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় খারাপ কোন রেকর্ড নাই। তাদের পরিবার জানিয়েছে, ঈদের খরচ যোগাতে তারা সাগরে মাছ ধরতে গেছে।

তিনি আরও বলেন, কক্সবাজারে ট্রলারে ১০ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনা প্রচার হওয়ার পর পুরো এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে চারিদিকে। শোকে কাতর সবাই।

অপরদিকে হোয়ানক ইউনিয়নের ছনখোলা পাড়া ১নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শামসুল আলম জানান, নিখোঁজ ট্রলারের মালিক শামশুল আলম দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে অন্যজনের বোটে শ্রমিক (জেলে) হিসেবে কাজ করতেন। বছর খানেক আগে ভিটি জমি বিক্রি করে একটি বোট ক্রয় করে।

সেই বোট নিয়েই সাগরে মাছ ধরতে যায়। তিনি এলাকায় শান্তিপ্রিয় পরিশ্রমী মানুষ হিসেবেই পরিচিত। তার সাথে যাওয়া মুহাম্মদ মুসা নামের অপর জেলের বাড়ি নোয়াখালীতে। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে এলাকায় থাকেন। অন্যদিকে চকরিয়া উপজেলার নিখোঁজ ৩ জনই জেলে হিসেবে দীর্ঘদিন সাগরে মাছ ধরছে বলে জানা যায়।

সারাদেশ-এর আরও খবর