সালাহউদ্দিন আহমদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত!

  বিশেষ প্রতিনিধি    10-09-2022    118
সালাহউদ্দিন আহমদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত!

প্রায় সাত বছর চার মাস ধরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে আটকা রয়েছেন বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘স্থায়ী কমিটি’র সদস্য ও সাবেক যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ। অবৈধভাবে প্রবেশের অভিযোগে হওয়া মামলায় শিলংয়ের একটি আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেলেও দেশটির রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের কারণে দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে বিএনপির প্রভাবশালী এই নেতার। সুত্র মতে, দেশটির আদালতে বারবার শুনানির তারিখ পড়লেও তা পিছিয়ে যাচ্ছে। ফলে নিম্ন আদালতের রায়ের পরও চার বছর ধরে সেখানেই আটকে আছেন। পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের অভিযোগ- রাষ্ট্রপক্ষ ইচ্ছাকৃতভাবে আপিলের শুনানি করছে না। এদিকে সালাহউদ্দিন আহমদের শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ হয়েছে। পরিবারের দাবি, তিনি কিডনি, হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। আগের মতো হাঁটাচলাও করতে পারেন না। দীর্ঘ ৬২ দিন নিখোঁজ থাকার পর ২০১৫ সালের ১১ মে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের গলফ লিংক মাঠে বিপর্যস্ত অবস্থায় পাওয়া যায় সালাহউদ্দিন আহমদকে। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা হয়। সালাহউদ্দিন আহমদের পরিবারের মতে, ভারতের শিলংয়ে অনুপ্রবেশের মামলায় নিম্ন আদালত থেকে বেকসুর খালাস পান তিনি। কিন্তু সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দেশটির রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতে আপিলের পর সেটার আর মুভমেন্ট নেই। ওভাবেই কাগজ পড়ে আছে। আদালত শুধু তারিখ দিচ্ছে, আবার হাজিরার তারিখ দেয়। তাদের মতে, করোনার কারণে ২০২০-২১ সালে দেশটির কোর্ট-কাচারিও বন্ধ ছিল। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও আপিল শুনানি হচ্ছে না। তাই দীর্ঘদিন শিলংয়ে নিঃসঙ্গ একাকি জীবন কাটানো সালাহউদ্দিন আহমদ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী এডভোকেট হাসিনা আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এমনটিই জানিয়েছেন। হাসিনা আহমেদ ২০০৮ সালে কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসন থেকে জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রার্থী হিসাবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে আসনটি থেকে তার স্বামী সালাহউদ্দিন আহমদ তিনবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য ছিলেন। সালাহউদ্দিন আহমদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত, আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিল পরিবার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের শেষের দিকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তাল, বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেকে জেলে, কেউ কেউ আত্মগোপনে, তখন দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেন দলটির তখনকার যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ। পরের বছর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সামনে রেখে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে বিএনপি ও ২০ দল। টানা অবরোধ কর্মসূচির সময় গ্রেপ্তার এড়াতে সালাহউদ্দিন আহমদ অজ্ঞাত স্থান থেকে গণমাধ্যমে পাঠাতেন দলের বিবৃতি ও ভিডিও বার্তা। বেশ কিছুদিন এভাবে চলার পর ওই বছরের ১০ মার্চ রাতে ঢাকার উত্তরা এলাকার একটি ভবন থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে একদল অস্ত্রধারী তাকে ‘অপহরণ’ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরে ভারতের শিলংয়ে তার সন্ধান পাওয়া যায়। পরিবার যা বলছে সালাহউদ্দিন আহমদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘গত মাসে ভারত থেকে এসেছি। উনার শরীরের অবস্থা আগের চেয়েও খারাপ। এখন ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। দীর্ঘদিনের নিঃসঙ্গ জীবনে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। আবার আদালতে শুনানি না হবার কারণে প্রতি মাসে তাকে আদালতে হাজির হতে হয়। বিচারক বারবার তারিখ দেন আর বলেন- পরের ডেটে (তারিখ) আসেন।’ এদিকে সালাহউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে দেশে যেসব মামলা ছিল সেগুলো দলের পক্ষ থেকে তদারকি করা হয়। অনেক মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন থানায় ২৭টি মামলা রয়েছে। ২০১৫ সালে অবরোধের সময় বেশ কয়েকটি মামলা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- বিস্ফোরক দ্রব্য, বিশেষ ক্ষমতা আইন ও হত্যার অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় তিনটি, বিস্ফোরক আইন ও হত্যার ঘটনায় রামপুরা থানায় দুটি, বিস্ফোরক আইন ও পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার ঘটনায় ভাটারা থানায় দুটি এবং হত্যা ও বিস্ফোরক আইন ও হত্যার ঘটনায় কুমিল্লায় আরও দুটি মামলা রয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় যান কি-না বা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কোনো প্রস্তুতি আছে কি না এমন প্রশ্নে স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘নির্বাচন বিষয় পার্টি চাইলে তখন দেখব। আর নির্বাচনী এলাকাতেও এখন আর যেতে পারি না, কারণ আমার স্বামী (সালাহউদ্দিন) খুব অসুস্থ। তাকেই এখন সময় দেয়ার চেষ্টা করছি। এজন্য মাঝেমধ্যে ভারতে তার কাছে যাই। কারণ, একা একটা মানুষ কত বছর নিঃসঙ্গ থাকতে পারে।’ বর্তমানে বিএনপির এই নেতা শিলংয়ের একটি কটেজে রুম ভাড়া নিয়ে থাকছেন। দেশে ফেরানোর বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ আছে কি না- এমন প্রশ্নে সাবেক এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘ওনার (সালাহউদ্দিন) কথা কি কারও মনে আছে? আর তাকে দেশে ফেরাতে কোনো রাস্তাই বাদ রাখিনি। এখন আপিল নিষ্পত্তি যত দিন না হয়, তত দিন আমাদের আর কিছু করার নেই। কী হবে এটার ভবিষ্যৎ, সেটা আল্লাহ জানেন। সবকিছু এখন আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছি। তিনি যদি সহায় হন তাহলে নিজ দেশে ফিরতে পারবেন।’ ‘ভিত্তিফলক’ ভাঙলেই কী একজন সালাহউদ্দিন আহমদকে মুছে ফেলা যায়! সালাহউদ্দিন আহমদ, এই সেই দরজা, যার পেছনের কক্ষটিতে নির্বাসিত জীবন কাটান তিনি। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরের সানরাইজ গেষ্ট হাউসে ২০১৯ সালের ৪ অক্টোবর রাতে তোলা ছবি। অনুপ্রবেশের মামলায় সাড়ে তিন বছর পর ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর বেকসুর খালাস পান সালাহউদ্দিন আহমদ। তবে পাসপোর্ট ও ভিসা না থাকায় তাকে ভারতেই অবস্থান করতে হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ২৭ এপ্রিল রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দেশটির রাষ্ট্রপক্ষ। আবার ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফেরানোর মতো আসামি নন বিএনপির এই নেতা। আপিল শুনানি শেষ হলে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আলোচনা ও সম্মতির মাধ্যমে তাকে দেশে ফেরানো সম্ভব বলে জানিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর ও মন্ত্রণালয়। রাজনীতিতে এলেন যেভাবে ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাহউদ্দিন আহমদ। পরে তিনি চাকরি ছেড়ে কক্সবাজার-০১ আসনের সংসদ সদস্য হন এবং ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। নিখোঁজ হওয়ার সময় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমদ পরে ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম ‘স্থায়ী কমিটি’র সদস্য পদ পান। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদার জিয়ার এককালের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র সালাহউদ্দিন আহমদ। ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এলে বিএনপি চেয়ারপারসন তাঁর (মোদি) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেসময় খালেদা জিয়া সালাহউদ্দিন আহমদের বিষয়টি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। যেভাবে শিলংয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ ২০১৫ সালে উত্তরার একটি ভবন থেকে ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী’ পরিচয়ে একদল অস্ত্রধারী সালাউদ্দিন আহমদকে ‘অপহরণ’ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। নিখোঁজের দুই মাস পর ১২ মে মেঘালয়ের রাজধানী শিলংয়ের একটি রাস্তা থেকে মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় পুলিশ। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের মামলা হয়। এরপর থেকে তিনি শিলংয়েই অবস্থান করছেন। সুত্র : ঢাকা টাইমস

সারাদেশ-এর আরও খবর